একটা সময় টাইম-ট্রাভেল ছিল কল্পকাহিনির একটি অংশ। তবে বর্তমানে টাইম-ট্রাভেল শুধুমাত্র science fiction নয়। মূলধারার বিজ্ঞানেও গুরুত্বের সাথে টাইম-ট্রাভেল স্টাডি করা হচ্ছে। আইজ্যাক নিউটন মনে করতেন মহাবিশ্বের সকল স্থানে সময় প্রবাহের হার সমান। অর্থাৎ পৃথিবীতে ১ ঘণ্টা অতিক্রম হওয়া মানে মহাবিশ্বের সকল স্থানে ১ ঘণ্টা অতিক্রম হবে। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করার পর সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব মতে মহাবিশ্বের সকল স্থানে সময় প্রবাহের হার এক হবে না। অর্থাৎ পৃথিবীতে ১ ঘণ্টা অতিক্রম হওয়ার মানে যে মহাবিশ্বের সকল স্থানে ১ ঘণ্টা অতিক্রম হবে বিষয়টি তা নয়। কোনো এক স্থানের এক ঘণ্টা অন্য কোনো স্থানের জন্য এক বছরও হতে পারে। নিউটনের মতে যা ঘটে গেছে অর্থাৎ অতীত হয়ে গেছে, তা সকলের জন্যই অতীত। কিন্তু আইনস্টাইনের মতে যা ঘটে গেছে অর্থাৎ অতীত হয়ে গেছে, তা সকলের জন্য অতীত নাও হতে পারে। সুতরাং যাকে আমরা অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মনে করছি তা আসলে বিভ্রম। অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই সাথে বিরাজ করে। সময়ের আচরণ সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তনের ফলে টাইম-ট্রাভেল এখন science fiction নয়। ভবিষ্যৎ-এ টাইম-ট্রাভেল সাধারণ ঘটনাতেও পরিণত হতে পারে। তখন হয়তো কাউকে এই বলে আক্ষেপ করতে হবে না যে,”ইশ! যদি দশ বছর পিছনে যেতে পারতাম তবে পড়াশুনাটা ভালোভাবে করতাম"।
সাধারণভাবে টাইম-ট্রাভেল বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে সময়ের আগে বা পিছনে যাওয়া। কোনো প্রকার শারীরিক পরিবর্তন বা বায়োলজিক্যাল চেঞ্জ ছাড়াই। কিন্তু টাইম-ট্রাভেল সম্পর্কে ভাবতে গেলে শারীরিক পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যাই হোক আপেক্ষিকতার তত্ত্ব মতে সময় একটি ডাইমেনশন। আমাদের পরিচিত ডাইমেনশন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা এগুলো সকল স্থানেই বিরাজ করে। এবং আমরা এই ডাইমেনশনগুলোর একটি পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে যেতে পারি। যেমন, সান্তাহার থেকে ঢাকা যাওয়া। এখন টাইম যেহেতু একটি ডাইমেনশন, তাহলে টাইমেরও একটি পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে যেতে পারা উচিত। টাইমের এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে যাওয়া হচ্ছে অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে যাওয়া। তার মানে টাইম-ট্রাভেলকে দুই দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত অতীতে যাওয়া, দ্বিতীয়ত ভবিষ্যতে যাওয়া। প্রথমে ভবিষ্যতে যাবার বিষয় নিয়ে ভাবা যাক। আমরা আমাদের নিজেদের অজান্তেই ভবিষ্যতে যাত্রা করেছি কিংবা করছি। যেমন, আপনি যখন প্লেনে চড়েন কিংবা দ্রুতগতির যানবাহনে চড়েন তখন আপনি নিজের অজান্তেই ভবিষ্যতে যাত্রা করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাত্রার বিষয়টি খুবই সামান্য। এক সেকেন্ডের কোটি কোটি কোটি ভাগের একভাগ সময়। যার ফলে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না।
কোনো বস্তু যখন গতিশীল থাকে তখন ঐ বস্তুর সময় স্লো হয়ে যায়। যেমন, পৃথিবীর ৪০০ কিলোমিটার উপরে থাকা ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশন ঘণ্টায় ২৮০০০ কিলোমিটার বেগে গতিশীল। ফলো ভূপৃষ্ঠে থাকা একজন মানুষ এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশনে থাকা নভোচারীর মধ্যে সময়ের পার্থক্য তৈরি হয়। এখন এই ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও বিশেষ আপেক্ষিকতা হিসেব করলে সময়ের পার্থক্য দাঁড়ায় ০.০০০০২৬৪৬ sec/day । অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষের সাথে ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশনে থাকা নভোচারীর মধ্যে একদিনে ০.০০০০২৬৪৬ sec পার্থক্য তৈরি হয়। এর অর্থ নভোচারীরা একদিনের ব্যবধানে ০.০০০০২৬৪৬ sec ভবিষ্যতে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কিছুটা এলোমেলো লাগছে তাইতো? বড় পরিসরে উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। মনে করুন আপনি ২০২৪ সালে একটি রকেটে করে আলোর বেগের ৯৯.৯৪% গতিতে স্পেস ভ্রমণে গিয়েছেন। এবং আপনার সাথে থাকা ঘড়িতে ১০ বছর অতিক্রম করার পর আপনি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। তাহলে আপনার হিসেব মতে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর পৃথিবীতে ২০৩৪ সাল চলবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে টাইম dilation এর কারণে পৃথিবীতে ২৯ বছর কেটে যাবে। আপনি পৃথিবীতে ফিরে এসে দেখবেন ২০৫৩ সাল চলছে। তার মানে আপনি ১৯ বছর ভবিষ্যতে চলে যাবেন। অর্থাৎ টাইম-ট্রাভেল। এখন এমন ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন এটি শুধুমাত্র ঘড়ির যান্ত্রিক দুর্বলতার কারণেই ঘটে থাকবে। কিন্তু না আপনার শারীরিক পরিবর্তনও এই সময় অনুযায়ীই হবে।
সেটা কেমন তা বোঝার জন্য ধরে নিলাম আপনারা যমজ দুই ভাই এবং আপনাদের বয়স ২০ বিশ বছর। এখন আপনি আপনার যমজ ভাইকে পৃথিবীতে রেখে আপনি আলোর গতির ৯৯.৯৪% গতিতে স্পেসে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে ১০ বছর ভ্রমণ করেন তারপর পৃথিবীতে ফিরে আসেন তবে পৃথিবী আসার পর আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার বয়স হবে ৩০ বছর। সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে থাকা আপনার যমজ ভাইয়ের বয়স হবে ৩০। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর আপনি দেখবেন আপনার যমজভাই এর বয়স হয়েছে ৪৯। তার শারীরিক পরিবর্তন ৪৯ বছরের মানুষের মতোই হবে। আপনার সময় স্লো হয়ে যাওয়া মানে আপনার ব্রেইনের ফাংশনও স্লো হয়ে যাবে। আবার আপনার সময় ফাস্ট হয়ে যাওয়া মানে আপনার ব্রেইনের ফাংশনও ফাস্ট হয়ে যাবে। সে অনুযায়ী আপনার শারীরিক পরিবর্তন আসবে। তবে এমন এক্সট্রিম টাইম dilationএর ক্ষেত্রে মানুষ সারভাইভ করতে পারবে কিনা এটি একটি বড় প্রশ্ন। শুধুমাত্র বেগের কারণেই সময় স্লো হয় তা কিন্তু নয়। শক্তিশালী গ্রাভিটির জন্যও সময় স্লো হয়। আপনি যদি এমন কোনো স্থানে যান যে স্থানের গ্রাভিটি খুবই শক্তিশালী তবে সে স্থানের সময় স্লো হয়ে যাবে।
এবার অতীতে যাবার বিষয়টি ভাবা যাক। আমাদের এখন পর্যন্ত ধারণা অনুযায়ী টাইম-ট্রাভেল করে অতীতে যাবার বিষয় প্রায় অসম্ভব। অতীতে যাবার বিষয়টি নিয়ে অনেক ধরণের ফিকশনাল চিন্তাভাবনা মানুষের রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও রয়েছে। বিজ্ঞানী Kip Stephen Thorne মনে করেন ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে অতীতে যাওয়া যেতে পারে। ওয়ার্মহোল হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দু'টি দূরবর্তী স্থানকে একত্রিত করা হয় ফলে স্থান দু'টির মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে আসে। Kip Stephen Thorne এর আইডিয়া অনুযায়ী মনে করুন মানুষ আর্টিফিশিয়াল ওয়ার্মহোল তৈরি করেছে। যার একটি মুখ থাকবে পৃথিবীতে অর্থাৎ পৃথিবীতে থাকা কোনো একটি ল্যাবে। অন্য মুখটি থাকবে একটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে থাকা বাহনে। ওয়ার্মহোলের মুখ দুইটি সবসময় নিজেদের মধ্যে কানেকশন বজায় রাখবে। দ্রুতগতির বাহনটি যদি আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে গতিশীল থাকতে পারে, তাহলে বাহনটিতে থাকা নভোচারীর ক্ষেত্রে টাইম স্লো হয়ে যাবে। ধরে নিলাম নভোচারীর ক্ষেত্রে ১০ বছর অতিক্রম হলে পৃথিবীতে ৩০ বছর অতিক্রম হবে। এখন মনেকরি ২০২৪ সালে একজন নভোচারী দ্রুতগতির এই বাহটির মাধ্যমে ১০ বছর স্পেসে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। এখন নভোচারীর বাহন যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবে পৃথিবীতে তখন ২০৫৪ সাল চলবে। সে অনুযায়ী বাহনে থাকা নভোচারীর ২০৩৪ সাল চলবে। তার মানে ওয়ার্মহোলের এক মুখে থাকবে ২০৩৪সাল এবং অন্য মুখে থাকবে ২০৫৪ সাল। পৃথিবীতে থাকা কোনো ব্যক্তি যদি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে নভোচারীর বাহনে চলে যান তবে তিনি ২০৫৪ সাল থেকে ২০৩৪ সালে চলে যেতে পারবেন। তিনি অতীত ভ্রমণ করবেন। তবে তিনি ২০৩৪ সালের পেছনে যেতে পারবেন না। এখন একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করি যার মাধ্যমে অতীতে যেকোনো সময়ে যাওয়া যেতে পারে বলে মনে হতে পারে। আপনি যত দ্রুতগতিতে চলতে থাকবেন আপনার সময় তত স্লো হতে থাকবে। গতি বৃদ্ধি করতে করতে আলোর গতি অর্জন করতে পারলে আপনার সময় স্থির হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমরা শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো স্কিপ করছি। যাই হোক আলোর গতিতে আপনার সময় স্থির। আপনি যদি আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলতে পারেন আপনার জন্য সময় রিভার্স হয়ে যাবে। আপনি আলোর চেয়ে যত বেশি গতিতে চলতে থাকবেন আপনার সময় তত বেশি রিভার্স হারে চলতে থাকবে। এখন আপনার সময় যদি রিভার্স হয়ে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই আপনি অতীতে যেতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে দুইটি প্রধান সমস্যা রয়েছে। প্রথমত আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আলোর চেয়ে বেশি গতি সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত আপনার সময় যদি রিভার্স হয়ে যায়, আপনি অক্সিজেন গ্রহণের পরিবর্তে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করবেন। এমন ক্ষেত্রে মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। এখন পর্যন্ত অতীতে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব। এখন আমরা যদি মনে নিই মানুষ কোনো প্রকার শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াই অতীতে যেতে সক্ষম হয়েছে তবে সেক্ষেত্রে বেশ কিছু প্যারাডক্স তৈরি হবে। যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে 'গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স'। বিষয়টি কেমন তা বোঝার জন্য মনে করুন, আপনি একটি টাইম মেশিন বানিয়ে অতীতে গিয়ে আপনার বাবাকে জন্ম দেবার আগেই আপনি আপনার দাদাকে হত্যা করে ফেলেছেন। তাহলে এখানে খেয়াল করুন আপনি যদি আপনার দাদাকে হত্যা করেন তবে আপনার বাবার জন্ম হবে না, যার ফলে আপনারও জন্ম হবে না। আর আপনার জন্ম না হলে আপনি টাইম মেশিন বানিয়ে অতীতেও যেতে পারবেন না। অর্থাৎ আপনি আপনার দাদাকে হত্যাও করতে পারবেন না। তার মানে এখানে একটি চক্রাকার সমস্যা তৈরি হয়েছে। এটিই হচ্ছে প্যারাডক্স। তবে প্রকৃতি প্যারাডক্স সমর্থন করে না। সুতরাং অতীতে যাওয়া সম্ভব হলেও গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স তৈরি হবে না। এই গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্সের সমাধান কী? অনেকের মতে যদি অতীতে যাওয়া সম্ভব হয় তবে আপনি অতীতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে পরিবর্তন করতে পারবেন না। আপনি আপনার দাদাকে হত্যা করতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হবেন। কোনোভাবেই আপনার দাদাকে হত্যা করতে পারবেন না। ফলে কোনো প্রকার প্যারাডক্স তৈরি হবে না। এই যুক্তির ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত রয়েছে। অতীতে যাওয়া গেলেও আমি অতীত পরিবর্তন করতে পারবো না এটি মানতে পারছি না। কারণ আপনি অতীতে জীবনযাপন করতে চাইলে আপনাকে কিছু না কিছু পরিবর্তন করতে হবেই । বাটারফ্লাই ইফেক্ট এর মতো সামান্য পরিবর্তনও অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কোনো মানুষ যদি অতীতে গিয়ে থাকেন তবে কী উদ্দেশ্যে গিয়েছেন সেটি তার ব্রেইন থেকে মুছে যাবে। আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে ভিন্ন অভিমত পোষণ করেন। আমরা জানি সাব এটমিক পার্টিকেলের আচরণ আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে সম্পূর্ণ অদ্ভুত। সাব এটমিক পার্টিকেলের উপর ভিত্তি করে অনেকে মনে করেন মানুষ যদি অতীতে যেতেও পারে তবে সে যাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্যারালাল ইউনিভার্সে । যার ফলে আমাদের ইউনিভার্সে কোনো প্রকার প্যারাডক্স তৈরি হবে না। অনেকে মনে করেন টাইম -ট্রাভেল এন্ট্রপির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এন্ট্রপি যেমন একমুখী টাইমও একমুখী যা শুধুমাত্র সামনের দিকে এগিয়ে চলে । যার কারণে অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু অতীতে যাওয়া সম্ভব নয় সেহেতু আপনার ও আপনার পরিবারের সাথে কাটিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো অনেক মূল্যবান। প্রত্যেকটি মুহূর্তকে একমাত্র স্মৃতিতেই ধরে রাখা সম্ভব ।
Thanks for reading. Feel free to send comments, questions, or recommendations to mortuzaahmmed@aol.com.