অনেকদিন ধরে আমার গ্রামের এলাকার ছেলেরা বলে আসছে , ‘চলো আমরা সবাই মিলে রক্তদহ বিল ঘুরে আসি। ' গ্রীষ্মের সময় কাঠফাটা রোদের মধ্যে কারো যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে না কিন্তু তারা বলে চলেছে যাওয়ার কথা । তাই তারা পরস্পরের মধ্যে চঁাদা তুলতে আরম্ভ করলো এই চিন্তা করে যে, সেখানে কিছু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে । যে যত পারে চঁাদা দিয়ে দিলো । কেউ ১০০ টাকা , কেউ ২০০ টাকা, কেউবা নিজ ইচ্ছায় ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিলো । চঁাদা তোলা শেষ হলে এলাকার তিন ছেলে সাওন, জিম ও আবিদ মিলে বাজার করার উদ্দেশ্যে রওনা হলো । সাওন সেদিন আমাকে মেসেজ দেয় বাজারে যাওয়ার জন্য কিন্তু সেদিন আমার হাতে কিছু কাজ থাকার কারণে আমি যেতে পারিনি বাজারে । আমাকে একটু ব্যাংকে যেতে হয়েছিল । ব্যাংক থেকে ফিরে দেখলাম তাদের বাজার করা হয়ে গেছে । তারা একেক জন জিনিসপত্র গোছানোতে ব্যস্ত । আমিও তাদের সাহায্য করার জন্য কিছু শুকনো কাঠের খণ্ড বহন করলাম এবং তাদের এগিয়ে দিলাম ।
হঠাৎ বিল প্রান্তে যাওয়ার প্ল্যান পরিবর্তন হয়ে গেলো । সবাই ঠিক করলো বিল পৌঁছানোর আগে হুইলাগাড়ি নামক একটি সুন্দর জায়গা রয়েছে সেখানে যাওয়ার । সবাই সেখানে যাবার মনস্থির করলো । আমিও তাদের পিছনে পিছনে গেলাম । আমার হাতে দু'টি ব্যাগ ছিল । একটিতে ছিল মাছ এবং একটিতে ছিল বড় কাপড়ের অংশ । সবাই গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলছে । এসময় আমার একটি গান মনে পড়ে গেলো, ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে ।' আসলে যারা শহরে থাকেন তারা গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার মজা পাবেন না । আসলে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হঁাটতে কখন যে পৌঁছে গেলাম বুঝতে পারলাম না । হয়তো বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ।
সেখানে আমাদের তথাকথিত 'জাফের মামা' যিনি রান্নাতে পারদর্শী তিনি মশলা ও চাল ধোয়ার দায়িত্ব নিলেন। তার মুখের গ্রামীণ হাসি যেন অদ্ভুত ।
আমিও তাদের সাহায্য করার জন্য লেগে গেলাম । কিছুক্ষণ পর দেখলাম মশলার কাজ হয়ে গেলো । আসলে খাবার আয়োজনে মাছের পোলাও রান্না করা হবে । আমার বরাবরই মাছের পোলাও পছন্দের । তাই আর লোভ সামলাতে পারলাম না । নিজে গিয়ে রান্নাতে একটু হাত বাড়ালাম । যদিও আমি রান্না করতে পারিনা তবুও কেন জানি মনে হলো আমি একটু হাত লাগাই । লবণ, তেল, হলুদ এবং আরে অনেক মশলা দিয়ে নাড়াতে থাকলাম আমি ।
কিছুক্ষণ নাড়ানোর পর আমি দায়িত্ব অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিলাম । কারণ আমি জানতাম রান্না আমার কাজ না হা হা । চলে গেলাম সবজি ধোয়ার জন্য । সবজি ধোয়া শেষ হলো । অন্যদিকে কেউ কেউ ছবি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । আমি তাদের সবার সাথে লেগে কাজ করার পরামর্শ দিলাম । কেউ শুনলো কেউ শুনলো না । এর ফাঁকে আমিও ক্যামেরা বন্দি হয়ে পড়লাম ।
দেখতে দেখতে পোলাও রান্না শেষ হলো । পোলাও এর গন্ধে চারিদিক ভরে গেলো । সবাই থালা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো । কেউবা শরবত , কেউবা পোলাও, কেউবা ফল এবং কেউবা পানির ব্যবস্থা করতে লাগল । আমার হাতে আনা বড় কাপড়ের অংশটি মাটিতে বিছানো হলো । সবাই বসে যেতে শুরু করলো । সবাই একসাথে বসে আহার করা যে কত আনন্দের ! মনে হলো যেন আমরা সবাই একটি পরিবার । সাধারণত গ্রামের লোকজন শহরের লোকজনের চেয়ে একটু বেশিই সাধারণ হয়ে থাকে । তারা একে অপরকে বিনা স্বার্থে সাহায্য করে থাকে । তাই পুরো গ্রাম একটি পরিবার মনে হয় আমার কাছে । এমনিতে চারিদিকে অপরূপ সৌন্দর্য তারপর কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, এক বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করেছিল ।
বন্ধুর অনুরোধে তথাকথিত সেলফিও তুলে নিলাম । আসলে প্রকৃতি আমার কাছে বরাবরের মতোই সুন্দর লাগে । তাই আমিও আমার স্মৃতির পাতায় সেই মুহূর্তকে বন্দি করতে চাইলাম । ভাবলাম প্রকৃতির চেয়ে সুন্দর কী বা হতে পারে ।
যাবার পালা চলে এলো তাই সবাই যে যার মতো সবকিছু গুছিয়ে নিতে লাগলো । চারিদিকে নিরবতা । মনে হচ্ছে আমরা যেন প্রকৃতিকে আমাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছি । প্রকৃতিও আমাদের যেন বিদায় জানাচ্ছে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । পাখিরা তাদের বাসায় ফিরতে আরম্ভ করেছে । মাগরিবের আজান হয়ে গেলো । চারিদিকে আজানের শব্দে ছেয়ে গেলো । আমাদের মধ্যে অনেকে আগেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে । কয়েকজন আমরা বাকি আছি যাবার । গ্রামের আইল পথ ধরে এগিয়ে চলেছি । যাবার পূর্ব মুহূর্তে আরেক টি ছবি তে অংশগ্রহণ করলাম ।
যাইহোক দিনটি অনেক আনন্দময় ছিল । সবার মধ্যে এক রকম মিল ছিল । হয়তো বা প্রাকৃতিক মিল । শহরের ব্যস্ততা কী আর গ্রামের নিরবতার কাছে টিকে ?
Thanks for reading. Feel free to send comments, questions, or recommendations to mortuzaahmmed@aol.com.